তিস্তার চরে মাদকের হাট

সীমান্ত এলাকা থেকে তিস্তার চর পেরিয়ে আসছে মাদক। বিশেষ করে ভারত সীমান্ত থেকে মাদকদ্রব্য আনা-নেওয়ার রুট হিসেবে এ চরাঞ্চলকে ব্যবহার করছে মাদক কারবারিরা। এ কারণে রংপুরের বিভিন্ন এলাকায় মাদক ব্যবসা আশঙ্কাজনকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সূত্র অনুযায়ী উত্তরের তিন জেলা কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট ও দিনাজপুরের সীমান্ত দিয়ে বেশি আসছে মাদক। গাঁজা, ফেনসিডিল, ইয়াবা, ইনজেকটিং মাদক সীমান্তবর্তী এসব জেলা থেকে সারাদেশে সরবরাহ করছে চোরাকারবারিরা। প্রাইভেটকারসহ বিভিন্ন মাধ্যমে ও কৌশলে বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে এ সিন্ডিকেট। ফলে তিস্তার চর যেন মাদকের ‘নিরাপদ’ হাট।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত এক বছরে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, রেঞ্জ পুলিশ, মহানগর পুলিশ, বিজিবি ও র‍্যাবের অভিযানে রংপুর বিভাগে বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্য উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ৩ লাখ ৫৬ হাজার ৭১১ পিস ইয়াবা, ৩৯ কেজি হেরোইন, ৭ হাজার ৭১৮ কেজি গাঁজা, ১ লাখ ২৪ হাজার ৬৭০ বোতল ফেনসিডিল, ১ লাখ ৮৩ হাজার ৯৮ পিস টাপেন্ডাডল, ৩৭ হাজার ৬০৯ অ্যাম্পুল ইনজেকশন ও ১০ গ্রাম আইস। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের আইনে মামলা হয়েছে ৮ হাজার ১১৫টি। ভারত থেকে সীমান্তবর্তী জেলাগুলোয় মাদক প্রবেশ করে সারাদেশে সরবরাহ করা হচ্ছে। এর মধ্যে কুড়িগ্রামে আসছে গাঁজা ও ফেনসিডিল এবং দিনাজপুর-লালমনিরহাটে আসছে ফেনসিডিল ও ইনজেকটিং মাদক। রংপুরের কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ইতোমধ্যে চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ীরা গ্রেপ্তার হয়েছে। তবে প্রকৃত মাদক ব্যবসায়ীদের তালিকা করার পর সেটা যাচাই করেই অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। অনেক মাদক ব্যবসায়ী এখনও বাইরে আছে উল্লেখ করে তারা জানান, অভিযানের ভয়ে মাদক ব্যবসায়ীরা ব্যবসার কৌশল কিছুটা পরিবর্তন করেছে। অভিযানে ফেনসিডিলের বোতলসহ দু’চারজন ব্যবসায়ী গ্রেপ্তার হলেও জামিনে ফিরে এসে আবারও তারা জড়িয়ে পড়ছে পুরোনো ব্যবসায়।

সরেজমিন ঘুরে জানা যায়, সীমান্তবর্তী লালমনিরহাট জেলার ২৮৪ কিলোমিটার সীমান্তপথের ৫৪ কিলোমিটার অংশে কাঁটাতারের বেড়া নেই। জেলার ১১টি সীমান্ত পথ দিয়ে অবাধে দেশে আসছে ভারতীয় মাদকদ্রব্য। অর্থের লোভে যুবসমাজের একটি বড় অংশ জড়িয়ে পড়েছে সীমান্ত অপরাধে। বিজিবির তিনটি ব্যাটালিয়ন ইউনিট কাজ করলেও ঠেকানো যাচ্ছে না মাদক চোরাচালানসহ সীমান্ত অপরাধ। লালমনিরহাটের পাঁচ উপজেলার সীমান্তপথে গড়ে উঠেছে মাদক চোরাচালানের শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এর মধ্যে লালমনিরহাট সদর ছাড়া আদিতমারী, কালীগঞ্জ, হাতীবান্ধা ও পাটগ্রাম সীমান্তপথে আসা মাদক সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ছে তিস্তার চর পেরিয়ে। রংপুরের গঙ্গাচড়ার মর্নেয়া থেকে নোহালী পর্যন্ত প্রায় ১৯ কিলোমিটার তিস্তা প্রতিরক্ষা ডানতীর বাঁধের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে ঢুকছে এসব মাদকের চালান। বিশেষ করে লালমনিরহাটের কালীগঞ্জের কাকিনা হয়ে রংপুরের গঙ্গাচড়ার মহিপুর মাদকের নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। সে কারণে গঙ্গাচড়াও এখন পরিণত হয়েছে মাদকের হটস্পটে।

গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা জানান, হুন্ডি মাইদুল ইসলাম ও তার সহযোগীরা চোরাকারবারির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়ার চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। সে অনুযায়ী তদন্ত প্রতিবেদনও প্রেরণ করা হয়েছে। শিগগির ওই মাদক সিন্ডিকেটের হোতারা আইনের আওতায় আসবে বলে দাবি করেন তিনি।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হাতীবান্ধার দইখাওয়াসহ ঠ্যাংঝাড়া, ফকিরপাড়া, দোলাপাড়া, সিঙ্গিমারী, আমঝোল সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন আসছে মাদকের চালান। আর এজন্য এলাকাভিত্তিক রয়েছে লাইনম্যান। তাদের মাধ্যমে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা তোলা হয় মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে। সেই টাকা অংশভেদে চলে যায় সিন্ডিকেটের বাকি সদস্যদের কাছে। এলাকায় ‘রাতের রাজা’ নামে পরিচিতি ভুট্টুর নেতৃত্বে সীমান্তজুড়ে চলছে মাদকের জমজমাট ব্যবসা।

অনুসন্ধানে জানা যায়, তিস্তার ওপারের লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলা। এখানকার চন্দ্রপুর ইউনিয়নের খামারভাতি এলাকাটি মাদকের আখড়া বলে বেশ পরিচিত। এসব এলাকায় দিনে কৃষিকাজের নাম করে ভারতীয়রা বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। তেমনি বাংলাদেশিরাও ভারতের অভ্যন্তরে প্রবেশ করছে। তাদের অনেকের কাছে রয়েছে দু’দেশের জাতীয় পরিচয়পত্র। মাদক ব্যবসাসহ বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত হয়ে চোরাই পথ দিয়ে ভারতে গিয়েও অবস্থান করেন তারা। সেখান থেকে প্রকাশ্যে গাঁজা, ফেনসিডিল, ইয়াবা ও হেরোইনসহ বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য পারাপার করছে। স্থানীয়রা জানান, মাদক স্পট নামে খ্যাত উপজেলার খামারভাতিসহ বিভিন্ন স্পটে দিনরাত ২৪ ঘণ্টাই খুচরা ও পাইকারি বিক্রি হয় ফেনসিডিলসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্য। প্রতিদিন মাদক সেবন করতে কয়েকশ মোটরসাইকেল ও প্রাইভেটকারে করে রংপুর শহরসহ দূরদূরান্ত থেকে এখানে আসে তরুণরা।

হাতীবান্ধা ও কালীগঞ্জের মতো লালমনিরহাটের সীমান্তঘেঁষা আদিতমারীর বামনের বাসা, আমেনা বাজার, হাজীগঞ্জ, ভেলাবাড়ি ও দুর্গাপুর এবং পাটগ্রামের দহগ্রাম, আঙ্গোরপোতাসহ সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে মাদকের কারবার। যা তিস্তা নদী পেরিয়ে রংপুর তথা উত্তরাঞ্চলের গণ্ডি ছেড়ে চলে যাচ্ছে সারাদেশে।

এ ব্যাপারে লালমনিরহাট ১৫ ব্যাটলিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল এসএম তৌহিদুল আলম বলেন, সীমান্ত অপরাধ নিয়ন্ত্রণে বিজিবির কঠোর নজরদারি ও জোর তৎপরতা রয়েছে। তবে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করে সমন্বিতভাবে কাজ করলে সীমান্ত অপরাধ কমে আসবে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর রংপুর বিভাগীয় কার্যালয়ের অতিরিক্ত পরিচালক আলী আসলাম হোসেন বলেন, মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার রোধে সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। মাদকের বিস্তার রোধে রংপুর বিভাগের জেলা-উপজেলা পর্যায়ে আলোচনা সভা, কর্মশালা, লিফলেট বিতরণ, কমিউনিটি ভলান্টিয়ার টিম গঠনসহ নানা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর।

রংপুর বিভাগীয় কমিশনার হাবিবুর রহমান বলেন, সরকার মাদকের বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য তৃণমূল পর্যায় থেকে মাদকবিরোধী নানা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। সরকারি উদ্যোগে জেলায় জেলায় মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্র তৈরি হচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *