গরুর ট্রাক দেখলে একদিকে যেমন লাঠিয়াল বাহিনী ছুটে আসতো অন্যদিকে পুলিশের কৌশলী চাঁদাবাজি। মহাসড়কে প্রতিবছর ঘাটে ঘাটে চাঁদাবাজির কারণে অতিষ্ঠ ছিলেন ট্রাকচালক ও ব্যাপারীরা। কিন্তু এবার চিত্র পাল্টেছে। সেই লাঠিয়াল বাহিনীর দৌরাত্ম্য নেই, নেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চাঁদাবাজিও।
উত্তরের জেলা নীলফামারী ও নওগাঁ থেকে গরুর ট্রাকে ঢাকায় যাওয়ার পথে মহাসড়কে চাঁদাবাজির দৃশ্য চোখে পড়েনি। তবে ট্রাক শ্রমিক-মালিকের নামে নিয়মিত চাঁদা ওঠানো হচ্ছে উত্তরের জেলায়। সেইসঙ্গে কৌশলী চাঁদাবাজির চেষ্টাও ছিল। উত্তরের সব জেলায়ই প্রতি বছর কোরবানির ঈদের সময় চাঁদাবাজি হয়। ঢাকায় যেতে উত্তরের ১৬ জেলায় কমপক্ষে ২২ স্থানে চাঁদাবাজির কবলে পড়তে হয়। তার মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী ও নওগাঁ এবং জয়পুরহাট থেকে ছেড়ে যাওয়া ট্রাকগুলোকে অন্তত সাত স্থানে চাঁদা দিতে হতো।
রংপুর বিভাগের আট জেলা থেকে গরুর ট্রাক ঢাকায় যেতে কমপক্ষে ১৩টি স্থানে চাঁদা দিতে হয়। এই চাঁদাবাজি হয় মহাসড়কেই। চাঁদাবাজির তালিকায় আছে মাথায় লালফিতা বাধা লাঠিয়ান বাহিনী, পরিবহন শ্রমিক, সরকারি দলের অঙ্গসংগঠনের কর্মী, স্থানীয় প্রভাবশালী এবং পুলিশের তিন স্তর। নানা পয়েন্টে ট্রাক থামিয়ে চাহিদা অনুযায়ী চাঁদা দিতে বাধ্য করা হয়। চাঁদাবাজির পয়েন্টগুলোর মধ্যে সৈয়দপুর গোলচত্বর মোড়, দিনাজপুর টার্মিনাল এলাকা, রংপুরের মর্ডান মোড়, রংপুর টার্মিনাল এলাকা, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ, ফাঁসিতলা, বগুড়ার মোকামতলা, মহাস্থান, মাটিডালি, চারমাথা, বনানী, শেরপুর, নওগাঁর নিয়ামতপুর, সিরাজগঞ্জের কর্ডার মোড়, বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম ও পূর্ব এবং টাঙ্গাইলের এলাঙ্গী এলাকা উল্লেখযোগ্য। এসব পয়েন্টে চাঁদার পরিমাণও একেক জায়গায় একেক ধরনের। কোথাও ৫০ টাকা, কোথাও ৫০০ টাকা। এ অনুযায়ী উত্তরের জেলা থেকে গরুর ট্রাক ঢাকায় যেতে চাঁদা গুনতে হয় কমপক্ষে ১৫ হাজার টাকা।
একাধিক গরুর ব্যাপারী ও ট্রাকচালকের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। তারা এটাও জানিয়েছেন, শুধু ট্রাক মালিক-শ্রমিক নামে সংগঠন ছাড়া পথে পথে আর কোথাও চাঁদাবাজি এবার নেই। বরং গাইবান্ধা জেলার গেবিন্দগঞ্জ তিনমাথা মোড়ে পুলিশ ক্যাম্প বানিয়ে মাইকিং করছে গরুর ট্রাককে কোনো প্রকার চাঁদা না দেওয়ার জন্য। চাঁদাবাজি বন্ধে সম্প্রতি অতিরিক্ত আইজিপির সঙ্গে বগুড়ায় বৈঠক করেন পরিবহন মালিক সমিতি, পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন ও বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা। তারা আইজিপিকে চাঁদা বন্ধে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ জানান। এরপর চাঁদাবাজি বন্ধে গত ১ জুন থেকে অভিযান শুরু করে পুলিশ।
এরপরও সড়কে বিচ্ছিন্ন কিছু চাঁদাবাজি চলছে। উত্তরবঙ্গের সৈয়দপুর ওয়াপদা গোলাচত্বর, রংপুর বাস টার্মিনালের পাশে, বগুড়া চারমাথা ভবের বাজার ও নওগাঁর নিয়ামতপুরে শ্রমিকের আড়ালে বহিরাগত কিছু যুবক ট্রাক থামিয়ে চাঁদা তুলছেন।
পরিবহন সংগঠনের নেতারা জানান, সড়ক-মহাসড়ক, বাস-ট্রাক টার্মিনাল বা অন্য কোথাও কোনো ধরনের অবৈধ চাঁদা তোলা যাবে না। মালিক-শ্রমিক সংগঠনের চাঁদা নিজ নিজ অফিস থেকে সংগ্রহ করা যাবে। কোনো জেলা বা উপজেলার কোনো শাখা সংগঠনের উপকমিটিও সড়ক ও মহাসড়ক থেকে অর্থ আদায় করতে পারবে না। ট্রাকে বসা গরুর ব্যাপারী শাহজালাল মুন্সিগঞ্জের বাসিন্দা। দীর্ঘ ১৮ বছর যাবত এ ব্যবসা করছেন। উত্তরাঞ্চলের মধ্যে রংপুর বিভাগের জেলাগুলোয় গরুর দাম তুলনামূলক কম পাওয়ায় এ অঞ্চলের হাট এবং ছোট ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে গরু কিনে জড়ো করে ঢাকা ও চট্টগ্রামে নিয়ে যান।
কথা প্রসঙ্গে তিনি বললেন, এ বছর চাঁদাবাজির ঝুট ঝামেলা নেই। প্রতিবছর থানা পুলিশ, হাইওয়ে পুলিশ ও ট্রাফিক পুলিশ এই তিন স্তরেই রংপুর অঞ্চলের হাট থেকে ঢাকা পার হওয়া পর্যন্ত দিতে হতো কমপক্ষে ৯ স্থানে চাঁদা। সঙ্গে দিতে হতো ট্রাক পরিবহন মালিক-শ্রমিক এবং সরকারি দলের নানা সংগঠনকে। এভাবে পথে পথে ১৩ স্থানে ট্রাক প্রতি প্রায় ১৫ হাজার টাকার মতো চাঁদা দিতে গিয়ে লাভের মুখ তেমন দেখা যেতো না। এবার অনেকটা স্বস্তিতে আছেন বলে তার অভিমত।
রংপুর জেলা ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি হাফিজুর রহমান বলেন, গরুর ট্রাকেই শুধু নয়, সব ধরনের ট্রাক থেকেই পরিবহন শ্রমিক কল্যাণ ফান্ডের জন্য ৩০ টাকা করে নেওয়া হয় ট্রাক প্রতি। হাইওয়ে পুলিশের রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত ডিআইজি মোজাম্মেল হক জানান, এখানকার মহাসড়কের পাশে ১৫টি হাইওয়ে থানার পুলিশকে মাঠে নামানো হয়েছে। তারা মাইকিং করে চালকদের সতর্ক করছেন। যেকোনো পরিস্থিতিতে অভিযান পরিচালনা করতে একাধিক মোবাইল টিমও প্রস্তুত রাখা হয়েছে। সাধারণত যারা মহাসড়কে চাঁদাবাজি করে এদের চিহ্নিত করে তালিকা তৈরি করা হয়েছে।
ট্রাক-কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতির যুগ্ম-সম্পাদক হাসানুল কবির বলেন, পণ্যবাহী ট্রাকে আগে যেভাবে চাঁদাবাজি হতো তার চেয়ে অনেকাংশে কমেছে। একটি গাড়ি রংপুর থেকে ঢাকায় পৌঁছাতে ১০ থেকে ১২ জায়গায় চাঁদা দেওয়া ছিল বাধ্যতামূলক।